স্বদেশ ডেস্ক:
পিটা লিমজারোয়েনরাতের দল ‘মুভ ফরওয়ার্ড’ থাইল্যান্ডের নির্বাচনে অবিশ্বাস্য জয় পেয়েছে। গত এক দশক ধরে সেনা-সমর্থিত সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে ভোটাররা। অন্য যেকোনো দলের তুলনায় ‘মুভ ফরওয়ার্ড পার্টি’ (এমএফপি) আসন এবং ভোট – দুটোই বেশি পেয়েছে।
প্রাথমিক ফলে দেখা যাচ্ছে, সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়ে এমএফপি থাই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের ৫০০ আসনের মধ্যে ১৫১টি আসনে জয়লাভ করেছে।
যে দেশটিতে দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসন চলেছে, সে দেশে এই বিজয়কে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
‘এই সেন্টিমেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবং এটা হচ্ছে আসল সময়, ’ব্যাংককে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পিটা লিমজারোয়েনরাত এই কথা বলেন। ব্যাংককে তার দল ব্যাপক বিজয় পেয়েছে। এখানে ৩৩টি আসনের মধ্যে ৩২টি পেয়েছে ‘মুভ ফরওয়ার্ড’ পার্টি।
পিটা লিমজারোয়েনরাত কে?
পিটা লিমজারোয়েনরাতের জন্ম থাইল্যান্ডের এক ধনী পরিবারে, রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার পরিবারের। তার বাবা ছিলেন থাইল্যান্ডের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং তার চাচা ছিলেন থাইল্যান্ডের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
পিটা লিমজারোয়েনরাত বলেছেন, রাজনীতিতে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেন নিউজিল্যান্ডে স্কুলছাত্র থাকাকালে।
তিনি থাইল্যান্ডের থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক পলিসিতে মাস্টার্স করেন। এমবিএ করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে।
তবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়ে। পরে তিনি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি গ্র্যাবের নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন থাই অভিনেত্রী ও মডেল চুটিমা টিনপানাটকে, পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এখন তিনি তার সাত বছর বয়সী মেয়ে পিপিমকে নিয়ে একাই থাকেন।
থাইল্যান্ডে ২০২০ সালে প্রায় মাসখানেক ধরে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল এমএফপি। এবার নির্বাচনে এমএফপি প্রার্থীদের অনেকেই ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতা। আর ২০২০ সালের সেই বিক্ষোভের মতো এমএফপির বিজয়েও বড় ভূমিকা রেখেছে তরুণ, নিবেদিতপ্রাণ ভোটাররা।
পিটা লিমজারোয়েনরাতের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০১৯ সালে ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি (এফএফপি) থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থাইল্যান্ডের বিলিওনিয়ার ও সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক থানাথর্ন জুংরুংগ্রুয়াংকিট। থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে এফএফপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে এবং দেশটির রাজনীতিতে নাড়া দেয়।
থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্রপন্থী সামরিক অফিসার, আমলা এবং বিচারকরা তখন রীতিমত জোট বেঁধে সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে এই দলটিকে বিলুপ্ত করে, এর নেতাদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করে। এরকম ঘটনা থাইল্যান্ডে আগেও বহুবার করা হয়েছে। দলটির নেতা থানাথর্নকে সংসদ সদস্য পদে অযোগ্য করা হয়।
এর পরপরই এমএফপি গঠন করে নতুন নেতা নির্বাচন করা হয় পিটা লিমজারোয়েনরাতকে। এফএফপিকে নিষিদ্ধ করার পরে থাইল্যান্ডে হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষোভ করতে। তাদের দাবি ছিল, সংবিধান সংস্কার, নতুন নির্বাচন এবং ভিন্ন মতাবলম্বী মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানির প্রতিবাদে।
পিটা লিমজারোয়েনরাতকে একসময় বলা হতো থাইল্যান্ড পার্লামেন্টের ‘উদীয়মান নেতা’ হিসেবে। বিরোধী এমপি হিসেবে পিটা লিমজারোয়েনরাত পার্লামেন্টে যেসব বক্তৃতা দেন, তা শিগগিরই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা খর্ব করা এবং রাজতন্ত্র সম্পর্কিত আইনে সংস্কারের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়ে কথা বলছিলেন।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির উত্থান
নির্বাচনের আগে যখন প্রচারাভিযান চলছিল, তখন এই তরুণ দলটির পক্ষে এরকম সমর্থনের আঁচ সহজেই পাওয়া যাচ্ছিল। থাই সোশ্যাল মিডিয়া তাদের পক্ষে নানা রকম ‘মিম’ দিয়ে সয়লাব করে দেয়া হয়েছিল। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নামের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকেই তাদের বিরাট পদক্ষেপ নেয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করছিল।
রোববার থাইল্যান্ড জুড়ে ভোটের বুথগুলোতে বাস্তবেও সেই একই ধরনের ‘বিরাট পদক্ষেপ’ নিতে দেখা গেছে ভোটারদের। ভোটের দিন ভোটাররা কেবল এভাবেই জানাতে পারছিলেন কোন দলের পক্ষে তারা ভোট দিচ্ছেন। কারণ থাইল্যান্ডের নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, ভোটাররা প্রকাশ্য বলতে পারেন না, কাকে তারা ভোট দিচ্ছেন। অনেকে উজ্জ্বল কমলা রঙের শার্ট, স্যান্ডেল এবং জুতো পরেছেন- যেটি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নির্বাচনী প্রচারাভিযানের রঙ।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রার্থীদের অর্থকড়ি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় ছিল অনেক কম। তাদের নির্ভর করতে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর। অনেক সময় তারা তাদের প্রচারাভিযানের জন্য ব্যবহার করেছে বাইসাইকেল। তাদের পরিকল্পনা যে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল, সেটি তাদের বেশ সাহায্য করেছে।
মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সাথে যুক্ত ছিল এরকম কোনো দলের সাথে তারা জোট সরকার করবে না।
থাইল্যান্ডে মানুষ পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে, সেটি পুরোপুরি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির পক্ষে গেছে। থাইল্যান্ডে ২৬ বছরের কম বয়সী ভোটারদের সংখ্যা বেশি নয়, ৫ কোটি ২০ লাখ ভোটারের মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু বয়স্ক ভোটারদের পক্ষে আনতে তারা কঠোর পরিশ্রম করেছে।
সূত্র : বিবিসি